এম আরমান খান জয় (গনমাধ্যমকর্মী ) : দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, এটি আনন্দের খবর। কিন্তু সেই আনন্দ মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, যখন আমরা তাদের বড় একটি অংশকে কাজে লাগাতে পারি না। আপনি জানেন কি? বিশ্বে বাংলাদেশেই শিক্ষিত বেকারের হার সর্বোচ্চ। শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা। এই শিক্ষার পেছনে শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও বিপুল বিনিয়োগ থাকে। শিক্ষিত তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ যদি বেকার থাকে, তাহলে আমরা ওই শিক্ষাকে কীভাবে মানসম্মত বা যুগোপযোগী বলব?
আপনার নিশ্চই জানেন, আমাদের বৈদেশিক আয়ের প্রধান খাত গার্মেন্টস। কিন্তু যেকোনো বিপর্যয়ে এদের দিন চলে না। রাষ্ট্র থেকে ভিক্ষা চাইতে হয়। অন্যসব লাভজনক সেক্টরগুলোর অবস্থাও একই। সর্বত্র কেবল লস আর লস।
আচ্ছা একটা সহজ প্রশ্ন, যেই চায়না, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এতো ধনী। সেখানে তারা তেরো নদী পার হয়ে কেনো বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস পণ্য কেনে। উত্তরটা সহজ, সুই-সেলাই নিয়ে বসে থাকার সময় তাদের নেই। তারা অ্যাপল, অ্যালফ্যাবেট (গুগল), মাইক্রোসফট এবং ফেসবুকের মতো কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা করে।
দেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের পাঁচকোটি টাকা কামাতে যেখানে ছয়মাস কয়েক হাজার শ্রমিক নিয়ে নির্ঘুম কাজ করতে হয়, সেখানে গুগল, ফেসবুক, ইয়াহু, আইবিএম, সিসকোসহ হাজার হাজার কোম্পানি মিনিটে কোটি কোটি ডলার নিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল, বিমান, অস্ত্রসহ শত শত প্রোডাক্টের জন্য আমরা এসব দেশকে অগ্রীম টাকা দিয়ে বসে থাকি।
একটা তথ্য দেই, মহামারীর সময়েও ব্যবসা বেড়েছে প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। অ্যাপল, অ্যালফ্যাবেট (গুগল), মাইক্রোসফট এবং ফেসবুক প্রতি সেকেন্ডে সম্মিলিতভাবে দুই হাজার মার্কিন ডলারেরও বেশি আয় করে, যেটি প্রতি মিনিটে এক লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়। পেনি স্টক ল্যাবের তথ্য এটি। ফোবর্স ম্যাগাজিনে তথ্যমতে, করোনাভাইরাসের এমন মহামারিতেও ২৫ জন ধনকুবেরের সম্পদ বিপুলহারে বাড়ছে। যারা প্রত্যেকেই প্রযুক্তি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু জানি, দেশের ব্যাংকিং খাতের বেশিরভাগ টাকাই গার্মেন্টস, নির্মাণ আর তথাকথিত খামারে যায়। বছর বছর এরা ব্যবসায় লস দেখালেও হাজার হাজার কোটি টাকা এদেরকেই দেওয়া হয়। এরপর সব টাকা মেরে দিয়ে সাধুবাবা সেজে বসে থাকেন।
সিঙ্গাপুর, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সমপর্যায়ে হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এসব অলিক স্বপ্ন দেখে লাভ নেই। বাস্তবতা উল্টো। গামছা কোম্পানি, টিউব লাইট কোম্পানি আর জর্দা কোম্পানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি কখনোই জাপান, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের পর্যায়ে যাবেনা। উল্টো সুযোগ পেলেই রাষ্ট্রকে চুষে খাবে।
চাপাবাজ-দুর্নীতিবাজ না, দেশের ব্যাংকিং খাতে ভিশনারি কিছু মানুষ বসানো দরকার। শিক্ষিত তারুণ্যকে সার্টিফিকেট বন্ধক রেখে হলেও সুদমুক্ত লোন দিতে হবে। শিক্ষাজীবন শেষ না হতেই লাখ লাখ তরুণ কাজে নেমে যাবে। কেউই চাকরির আশায় বসে থাকবেনা। পেটে ক্ষুধা নিয়ে কেউ অস্কার পাওয়া মুভি বানাতে পারেনা। নোবেল লরিয়েট হয় না। অ্যামাজন, আলীবাবাও হবে না।
আজ কিছু কথা বলতে চাই! শিক্ষা মানুষকে দেয় আলো এবং সম্মুখে চলার পথ। শিক্ষা যখন আলো দানের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের অন্ধকারে নিক্ষেপ করে তখন আমরা আসলে কাকে দায়ী করব? শিক্ষার্থীদের, না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে, না অভিভাবকদের, না শিক্ষাব্যবস্থাকে না রাজনৈতিক নেতৃত্বকে? আসলে কমবেশী সবাই দায়ী।
ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। পরিস্থিতি যে কত ভয়াবহ তা বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং চিত্রের মাধ্যমে বুঝা যায়। আমরা যখনই কোনো নিয়োগ পরীক্ষায় পরীক্ষা নিতে যাই, তখন দেখা যায় শিক্ষিত বেকারদের কী করুণ হাল। হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার ঘুরে বেরাচ্ছে চাকুরি নামক সোনার হরিণের পিছনে। এই হরিণ ধরার জন্য একশটি পদের বিপরীতে কয়েকশ কিংবা কয়েক হাজার প্রার্থী এসে হাজির হয়, সবাই উচ্চশিক্ষিত। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর তারা হয় বাবা-মার উপর কিংবা টিউশনি বা এ ধরনের কিছু অস্থায়ী পেশার উপর নির্ভর করে চলছে। কোথায় তাদের ভবিষ্যত, কোথায় দেশকে কিছু দেয়ার চিন্তা আর কোথায় সুকুমার বৃত্তি কিংবা দেশ সেবার চিন্তা। শুধুই বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এই চিন্তাই তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে সর্বক্ষণ। তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠে, যে দেশ তার নাগরিকদের তেমন কিছু দিতে পারে না, সে দেশের নাগারিকগণও সে দেশকে তেমন কিছু দিতে চায় না বা পারে না ।
ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে দেখা যায়, অনেক প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষার সব নিয়মকানুন জানা থাকা সত্ত্বেও কঠিন বাস্তবতা এবং জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত তাদেরকে মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডেই কেঁদে ফেলতে বাধ্য করেছে। কেউ এসেছে বোনের ভর্তির টাকা দিয়ে সুদুর উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় পরীক্ষা দিতে, কেই শয্যাগত পিতার চিকিৎসার টাকা যোগাতে পারছে না বরং সেই সংসারের উপরই নির্ভর করে তার শিক্ষিত জীবন চালাতে হচ্ছে, নেই বাবার জমি যা দিয়ে উপার্জন বাড়াতে পারে বা কিছু করে খেতে পারে।
এসব শিক্ষিত তরুণরা চাকুরীর পিছনে না ছূটে যদি নিজের গ্রামে ফিরে যায় এবং নিজেদের অল্প পুঁজি নিয়ে সমবায় সমিতি গঠন করে ছোটখাট ব্যবসা যেমন মাছের চাষ করা, হাঁস-মুরগীর ফার্ম করা, তরি-তরকারী ও উন্নত জাতের ফল চাষ, কৃষিকাজ উন্নত জাতের ধান উৎপাদন ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত হতে পারে।
একদিকে আমাদের শহরগুলো আর অধিক জনসংখ্যার ভার বইতে পারছে না। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন বস্তি। আর বস্তিতে সৃষ্টি হচ্ছে মাদক আর অসামাজিক কার্যকলাপের আখড়া। চরম স্বাস্থ্য হুমকির মতো পরিবেশ। কী দরকার শিক্ষিত তরুণদের ছোট মেসে থাকা, গুটিসুটি হয়ে এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা আর রাস্ট্রের উপর চাপ বাড়ানো। তারা নিজেরাই কর্মসংস্থান সৃস্টি করতে পারবে, উপকার করতে পারবে সাধারন মানুষের, নিজেরা কারো মুখাপেক্ষী হবে না। নির্ভরশীল হবে না সরকার কিংবা দেশের প্রতি।
দেশের প্রতিটি ছোট ছোট জেলা শহরগুলোর কলেজে এখন অনার্স পড়ার সুযোগ রয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা অনার্স পড়ছে পাঁচ, ছয় কিংবা সাত বছর যাবত। তারপর মাস্টার্স করছে আরও এক দু-বছর ধরে। পুরো সময়টাই তারা কৃষক কিংবা স্বল্প আয়ের বাবা-মার স্বল্প উপার্জনের উপর নির্ভর করে পড়াশুনা করছে। বছরের পর বছর তারা মেসে থাকছে আর স্বপ্নের দিন গুনছে কবে নিজে উপার্জনক্ষম হবে, কবে বাবা-মা ভাইবোনদের উপকার করবে কবে নিজে বিয়েশাদি করে সুখের সংসার গড়বে। কিন্তু পাশ করার পর শুরু হয় আর এক বিড়ম্বনা। চাকুরির জন্য ছুটতে হয় দ্বারে দ্বারে আর অফিসে অফিসে। কিন্তু চাকুরি মিলছে না। হতাশা নিত্যসঙ্গী।
কলেজে পড়ার সময়ই সমবায়ের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন কর্মমূলক ও উৎপাদনমুখী কিছু একটা করতে পারে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্ধিত জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। সংস্থাটির মতে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১২ কোটি ৯৮ লাখে পৌঁছাবে, যা হবে জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ। কিন্তু জনমিতির এই সুফল কাজে লাগাতে হলে প্রত্যেক নাগরিককে যেমন দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, তেমনি তাদের উপযুক্ত কাজের সংস্থান করতে হবে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত ও মান শক্ত না করেই একের পর এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে চলেছি, যা সনদ বিতরণ করলেও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেকার থাকা সত্ত্বেও অনেক খাতে উচ্চ বেতন দিয়ে বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তাদের যুক্তি, দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। এর অর্থ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন নতুন বিভাগ ও অনুষদ খুলছে, কিন্তু সেসব বিভাগ ও অনুষদের কোনো উপযোগিতা আছে কি না, সেসব ভেবে দেখার কেউ নেই। উপযুক্ত জনশক্তি তৈরির পাশাপাশি তাঁদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
Like
Comment
Share